রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তন্মধ্যে হযরত খাদীজা ও যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। বাকী ৯ জন স্ত্রী রেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেন। আজকের ব্লগে রাসূল সাঃ এর স্ত্রীদের নাম নিয়ে বিস্তারিত জানবো
এক নযরে উম্মাহাতুল মুমিনীনগনঃ
১. খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ বিবাহকালে রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল ২৫ ও তাঁর বয়স ৪০;
মৃত্যুসন- রামাযান ১০ম নববী বর্ষ;
মৃত্যুকালে বয়স ৬৫।
রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে তাঁর দাম্পত্যকাল- ২৪ বছর ৬ মাস বা প্রায় ২৫ বছর। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
জ্ঞাতব্য : পূর্বে তিনি দুই স্বামী হারান। প্রথম স্বামী ছিলেন উতাইয়িক্ব বিন ‘আবেদ বিন আব্দুল্লাহ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে এক ছেলে আব্দুল্লাহ ও এক মেয়ে জন্ম নেয় (ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৪)। তার মৃত্যুর পর ২য় স্বামী আবু হালাহ বিন মালেক তামীমী-এর ঔরসে হালাহ, তাহের ও হিন্দ নামে ৩ পুত্র ছিল। যারা সবাই পরে ছাহাবী হন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১০৮৬, ৮৯১৯, ৪২৩৮, ৯০১৩)। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্বামী এবং তিনি ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। রাসূল (ছাঃ)-এর ঔরসে তাঁর দুই ছেলে ক্বাসেম ও আব্দুল্লাহ ও চার মেয়ে যয়নব, রুক্বাইয়াহ, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান ক্বাসেমের নামেই তাঁর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। পুত্র আব্দুল্লাহর লক্বব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের’ (ইবনু হিশাম ১/১৯০)। জাহেলী যুগে খাদীজা ‘ত্বাহেরাহ’ (طَاهِرَةٌ) অর্থ ‘পবিত্রা’ নামে এবং ইসলামী যুগে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ (صِدِّيْقَةٌ) অর্থ ‘নবুঅতের সত্যতায় প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারিণী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্রথমা ও বড় স্ত্রী হিসাবে তিনি ‘খাদীজাতুল কুবরা’ নামেও পরিচিত।
আরো পড়ুন হযরত মুহাম্মদ সা: এর জীবনী
২. সওদা বিনতে যাম‘আহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স ৫০, তাঁর বয়স ৫০, বিবাহ সন- শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ,
মৃত্যুসন- ১৯ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দাম্পত্য জীবন- ১৪ বছর। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : ইনি প্রথমদিকে ইসলাম কবুল করেন। পরে তাঁর উৎসাহে স্বামী সাকরান বিন ‘আমর মুসলমান হন। অতঃপর উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। সাকরান সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সন্তানদের নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সওদা চরম বিপাকে পড়েন। একই সময়ে খাদীজাকে হারিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাধ্য হয়ে সংসারে পটু সওদাকে বিয়ে করেন ও তার হাতে সদ্য মাতৃহারা সন্তানদের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
৩. আয়েশা বিনতে আবুবকর রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৪, বিবাহ সন- শাওয়াল ১১ নববী বর্ষ। বিয়ের সময় বয়স ৬, স্বামীগৃহে আগমনের বয়স ৯, শাওয়াল ১ হিজরী,
মৃত্যুসন- ৫৭ হি.;
দাফন- মদীনা;
বয়স- ৬৩।
দাম্পত্য জীবন-১০ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনিই একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। নবীপত্নীগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও ফকীহা। জ্যেষ্ঠ ছাহাবীগণ বিভিন্ন ফাৎওয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন ও তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতেন (যাদুল মা‘আদ ১/১০৩)। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ৫৪টি এককভাবে বুখারী ও ৯টি এককভাবে মুসলিম। বাকী ১৯৭৩টি মুসনাদে আহমাদ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৪. হাফছাহ বিনতে ওমর রাঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স ৫৫, তাঁর বয়স ২২,
বিবাহ শা‘বান ৩ হিজরী;
মৃত্যুসন-৪১হি.;
দাফন- মদীনা;
বয়স-৫৯।
দাম্পত্য জীবন- ৮ বছর।
জ্ঞাতব্য : তাঁর পূর্ব স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ সাহ্মী প্রথমে হাবশা ও পরে মদীনায় হিজরত করেন। বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। ওহোদে যখমী হয়ে মারা যান। পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হাফছার বিয়ে হয়। তিনি মোট ৬০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৪টি, এককভাবে মুসলিম ৬টি। বাকী ৫০টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে। প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই।
৫. যয়নব বিনতে খুযায়মা রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৫; তাঁর বয়স প্রায় ৩০;
বিবাহ সন ৩ হিজরী;
মৃত্যুসন ৩ হি., বয়স ৩০;
দাফন- মদীনা;
দাম্পত্য জীবন ২ অথবা ৩ মাস।
জ্ঞাতব্য : পরপর দুই স্বামী হারিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশের সাথে তৃতীয় বিবাহ হয়। কিন্তু তিনি ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হলে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে চতুর্থ বিবাহ হয়। অধিক দানশীল ও গরীবের দরদী হিসাবে তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা ‘মিসকীনদের মা’ নামে খ্যাত ছিলেন।
৬. উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়াহ : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৬; তাঁর বয়স ২৬;
বিবাহ সন ৪ হি.;
মৃত্যুসন ৬০ হি.;
দাফন- মদীনা;
বয়স ৮০ বছর।
দাম্পত্য জীবন- ৭ বছর।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে তিনি সবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (ছাঃ)-এর আপন ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহর স্ত্রী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। আবু সালামাহ বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক হন। ওহোদে যখমী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে উম্মে সালামাহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। তাঁর দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয় (বুখারী হা/২৭৩২)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৩৭৮।
৭. যয়নাব বিনতে জাহশ : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ৩৬;
বিবাহ সন ৫হি.
মৃত্যুসন ২০হি.;
দাফন- মদীনা; বয়স ৫১ বছর।
দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফাতো বোন ছিলেন। প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর সাথে বিবাহ হয়। পরে যায়েদ রাঃ তালাক দিলে আল্লাহর হুকুমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিয়ে করেন।
তিনি মোট ১১টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২১৮)।
৮. জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ২০;
বিবাহ শা‘বান ৫হি.;
মৃত্যু সন ৫৬হি.;
দাফন- মদীনা;
বয়স ৭১।
দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি বনু মুছত্বালিক্ব নেতা হারেছ বিন আবু যাররাবের কন্যা ছিলেন। ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে বন্দী হয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শ্বশুরকুল হওয়ার সুবাদে একশ’-এর অধিক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। জুওয়াইরিয়ার প্রথম স্বামী ছিলেন মুসাফিহ বিন সুফিয়ান মুছতালিক্বী। তিনি মোট ৭টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে বুখারী ২টি, মুসলিম ২টি। বাকী ৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৯. উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৮; তাঁর বয়স ৩৬;
বিবাহ মুহাররম ৭হি.;
মৃত্যু সন- ৪৪হি.;
দাফন- মদীনা;
বয়স ৭২।
দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী তার প্রথম স্বামী ছিলেন। উভয়ে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী মারা যান। তিনি একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিধবা হন। রাসূল (ছাঃ) তার চরম বিপদের কথা জানতে পেরে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীর মাধ্যমে বাদশাহ নাজাশীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন ও তার সাথে বিবাহের পয়গাম পাঠান। নাজাশী স্বয়ং তার বিবাহের খুৎবা পাঠ করেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে ৪০০ দীনার মোহরানা পরিশোধ করেন ও সবাইকে দাওয়াত খাওয়ান। পরে তাঁকে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূত শুরাহবীল বিন হাসানাহ (রাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় পাঠিয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, রামলাহ ক্রমিক ১১১৮৫)। তিনি ৬৫টি হাদীছ বর্ণনা করেন।
১০. ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ১৭;
বিবাহ ছফর ৭হি.;
মৃত্যুর সন ৫০ হি.;
বয়স ৬০;
দাফন- মদীনা;
দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইসলাম কবুল করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিবাহিতা হন। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহূদী বনী নাযীর গোত্রের সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব-এর কন্যা এবং অন্যতম সর্দার কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্ব-এর স্ত্রী ছিলেন। উভয়ে নিহত হন। হযরত হারূণ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। স্ত্রীদের মধ্যে ইনিই ছিলেন একমাত্র ইহূদী কন্যা।
১১. মায়মূনা বিনতুল হারেছ : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ৩৬;
বিবাহ যুলক্বা‘দাহ ৭ হি.;
মৃত্যুর সন ৫১ হি.;
দাফন মক্কার নিকটবর্তী ‘সারিফে’;
বয়স ৮০।
দাম্পত্য জীবন- সোয়া তিন বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও খালেদ বিন অলীদ (রাঃ)-এর আপন খালা ছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মার সহোদর বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন। যিনি ইতিপূর্বে ৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্বের দুই স্বামী মারা গেলে ভগ্নিপতি হযরত আববাস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন। ফলে ৭ম হিজরীতে ক্বাযা ওমরাহ শেষে ফেরার সময় মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম-এর নিকটবর্তী ‘সারিফ’ নামক স্থানে উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়। এটিই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ বিবাহ। তিনি মোট ৭৬টি হাদীছ বর্ণনা করেন।