চিঠির শেষ শব্দ
পর্ব ৩ –
রাজু জানালার পাশে বসে।
তার হাতে তুলির দেওয়া সেই চিঠি।
চোখের ভিতরে যেন এক ঝড়।
চোখ বন্ধ করে বুকের গভীর থেকে আসে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস।
“তুলি… আমি… আমি কি হারিয়ে গেছিলাম?”
তুলি কিছু বলে না।
শুধু তার হাত ধরে রাখে নিঃশব্দে।
তার মুখের কাঁপনে, চোখের কোণে জমে থাকা জলে, যেন একটা চিরচেনা ঘ্রাণ ফিরে আসে রাজুর হৃদয়ে।
তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে—
“তুমি… তুমি আসবে তো?”
এই সেই বাক্য, যা একদিন রাজু তুলির ছাদ থেকে বলেছিল।
তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলে—
“আমি কোনোদিন যাইনি রাজু… আমি তো সেই জানালার পাশে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি… তোমার অপেক্ষায়।”
রাজুর দুই চোখ দিয়ে কান্না গড়িয়ে পড়ে।
চিঠির ভাঁজে রাখা সেই পুরোনো ছবি হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলে—
“এই আমি… আর এই তুমি… আর এই আমাদের হারানো সময়… সব ভুলে ছিলাম, তুলি… আমি শুধু ভুলে ছিলাম।”
পুষ্পের বিদায়, শান্ত কষ্ট
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্প সব দেখছে।
তার মুখে হাসি নেই, চোখে জল।
সে ধীরে এগিয়ে আসে।
রাজু তার দিকে তাকায়।
তাদের মাঝে বহু রাত, বহু কবিতা, বহু নিরবতা।
রাজু উঠে দাঁড়িয়ে পুষ্পর সামনে আসে।
একটি দীর্ঘ দম নিয়ে বলে—
“পুষ্প… আমি জানি, আমি তোমার পাশে থেকেছি, কিন্তু আমি তো তোমার ছিলাম না কোনোদিন।
তুমি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে, অথচ আমি… আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম তুলির কোনো ছায়ার।
আমি ভুল করেছি… কিন্তু আমার সেই ভুলটায়ও তুমি আলো এনেছিলে।
আমি ক্ষমা চাই। শুধু এইজন্য না যে আমি চলে যাচ্ছি…
আমি ক্ষমা চাই, কারণ তুমি সত্যিই ভালোবাসতে জানো।”
পুষ্প মাথা নিচু করে।
তার ঠোঁটে একটুকরো কষ্টের হাসি।
সে বলে—
“ভালোবাসা মানে তো আটকে রাখা না, রাজু।
ভালোবাসা মানে সেই মানুষটাকে এমন জায়গায় পাঠানো… যেখানে সে তার সত্যিকে খুঁজে পাবে।”
পুষ্প ফিরে যায় দরজার দিকে।
তুলি তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুই নারীর চোখে কোনো ঈর্ষা নেই, শুধু এক অদ্ভুত সম্মান।
পুষ্প শেষবারের মতো বলে—
“তোমরা যেদিন সন্তান পাবে, নামটা রেখো রশিদ। আমার বাবার নামে।
তিনি এক কবি ছিলেন, যার কাছে শব্দ ছিল ভালোবাসা। আর তুমি তো শব্দ থেকেই জন্মেছো, রাজু…”
আয়েশ – এক নিঃশব্দ ভাঙা চরিত্র
বইমেলা শেষ।
স্টলগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে।
আয়েশ এখন শুধু হেঁটে বেড়ান বইয়ের শূন্য ময়দানে।
হাতে একটি পুরনো বই, নিজের লেখা—যা কেউ পড়ে না।
সে আর আগের মতো বলে না, হাসে না।
মাঝে মাঝে স্টলের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে—
“আমার শব্দ ছিল, পাঠক ছিল না।
আর যারা শব্দ ছুঁতে জানে, তারা পাঠকের হৃদয় চেনে।”
আয়েশের বাসার টেবিলে পড়ে থাকে পুরনো খবরের কাগজ।
তাতে রাজুর ছবি।
বইয়ের নাম—চিঠির শেষ শব্দ
তুলির পাশে রাজু দাঁড়িয়ে।
আয়েশ চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন।
তার ঠোঁটে উঠে আসে এক বিষণ্ন স্বীকারোক্তি—
“আমি তো শুধু মঞ্চ দিয়েছিলাম,
গল্প তো ওদের ছিল।”
সেদিন রাতে আয়েশ লিখেছিলেন তার শেষ ডায়েরির পাতায়—
“আমি ব্যর্থ ছিলাম…
কারণ আমি ভালোবাসিনি নিজের শব্দকে।
আমি লিখেছি, ছাপিয়েছি, বিক্রি করেছি—কিন্তু নিজেকে ছুঁইনি কখনো।
আর রাজু… সে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে।
এটাই তো শিল্পের সত্য…
হারানোর মধ্যেই তো সৃষ্টি…”
তুলির রাজুকে নতুন করে পাওয়া
রাজু এখন তুলির সঙ্গে থাকে পুরান ঢাকার তিনতলা বাড়ির একটিতে।
তাদের ঘরে প্রতিদিন কবিতা লেখা হয়।
তুলির হাতে থাকে রাজুর খাতা।
সে প্রতিদিন বলে—
“আজ তোমার শব্দে আমি ছিলাম তো, রাজু?”
রাজু হাসে—
“তুমি ছাড়া শব্দ তো জন্মই নেয় না…”
তাদের ঘরে গানের আওয়াজ বাজে—
রবীন্দ্রনাথের সেই গান—
“আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ…”
তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে চা খায়।
তুলি কবিতা পড়ে শোনায় রাজুকে—
“ভালোবাসা যেমন নরম বাতাস,
তেমনই কখনো তীব্র আগুন
আর সেই আগুনে পুড়ে,
আমরা একেকজন কবি হয়ে উঠি—
নিঃশব্দে।”
শেষ দৃশ্য – নতুন চিঠি, নতুন শব্দ
তাদের সন্তান আসে পৃথিবীতে।
নাম রাখা হয়—রশিদ
পুষ্পর বাবার নাম ধরে।
রাজু তার জন্য একটি ছোট কবিতার বই লেখে—
“রশিদের জন্য চিঠি”
তুলির চোখে জল আসে সেই বই পড়ে।
আকাশে চাঁদ ওঠে।
বাতাসে কবিতার ঘ্রাণ।
ছাদের এক কোণে রাজু লিখে যাচ্ছেন—
তুলি পাশে বসে থাকে, ছেলে খেলে বারান্দায়।
তুলি বলে—
“রাজু… তুমি এখন কার জন্য লিখো?”
রাজু থেমে বলে—“তিনজনের জন্য—
তোমার জন্য, যে আমায় ফিরিয়ে এনেছে,
রশিদের জন্য, যে আমার ভবিষ্যৎ,
আর আয়েশের জন্য—
যে নিজে হারিয়ে গেছে আমাদের খোঁজে।”
তুলি রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে।
তার চোখে আবার সেই প্রতিজ্ঞা—
ভালোবাসা যে চিঠিতে লেখা থাকে না,
ভালোবাসা জন্ম নেয়… সেই চিঠির শেষ শব্দে।
শেষ
– আয়েশ ইকবাল রাজিব