চিঠির শেষ শব্দ

পর্ব:২

আয়েশ ইকবাল রাজিব।

ঢাকার এক অলস সকাল।

সূর্যের আলো তখনো পুরোপুরি জানালার কাঁচ ভেদ করে ঢোকেনি, কিন্তু আলোছায়ার সেই খেলা তুলির ঘরের দেয়ালে ভেসে উঠছে। একটা পুরনো খাম টেবিলের কোনায় পড়ে আছে, যার উপর ধুলোমাখা কালি দিয়ে লেখা—”রাজু”।

চিঠিটি এখন কেউ পড়ে না।
তবুও তুলি প্রতিদিন জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।
চোখ মেলে তাকায় পূর্বদিকের সেই ছাদটার দিকে, যেখানে রাজু একদিন দাঁড়িয়ে তাকে হাত নেড়ে বলেছিল—

“তুমি আসবে তো?”

……

সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই যেন সময় থেমে গেছে।
রাজু আর কোনোদিন আসেনি।

তুলির ঘরে এখন অনেক কিছু নেই—
শুধু একটা পুরনো ছবি, কয়েকটি চিঠি আর একটি হৃদয় যা এখনো অপেক্ষা করতে জানে।

তুলি সেইদিন বুঝেছিল—ভালোবাসা শুধু কবিতার জন্য নয়, জীবন বদলানোর শক্তিও বটে।

যেদিন রাজুর মৃত্যুর খবরে শহর উত্তাল হয়,
তুলির চোখে কান্না জমে থাকলেও মুখে একটা নীরবতা লেগে ছিল।
তার বাবা বলেছিল,

“তুই যদি ও ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস, এই বাড়ির মেয়ে না।”
বোন বলেছিল,
“তোর মতো কলঙ্কিনী আমাদের ঘরে থাকবে না।”

তুলি কিছু বলেনি।
একটা ব্যাগ গুছিয়েছে।
ভিতরে ছিল রাজুর লেখা চিঠি, একটি পুরনো ছবি আর কিছু টাকা।

চলে এসেছিল শহরের এক কোণে,
একটা ছাদঘেরা ঘরে, এক অচেনা জীবনের শুরুতে।

এদিকে রানা এখন জেলে।
কঠিন মুখ, গা ছমছমে দৃষ্টি, চোখে অনুশোচনা।
তাকে সবাই রাজুর খুনি মনে করে।
সে নিজেও তাই ভেবেছিল, কিন্তু
রাতের পর রাত ঘুম হয় না রানার।
ভেতরে এক অজানা প্রশ্ন ঘোরে—

“আমি তো বলেছিলাম ওকে ভয় দেখাতে,
কিন্তু ও তো মারা গেল কিভাবে?
লাশটাই বা এল কোথা থেকে?”

রানার চোখে ভেসে ওঠে এক চেহারা।
তাদের লোকেরা বলেছিল—রাজু বেঁচে ছিল, শুধু গুম করে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু তারপর হঠাৎ রাজুর লাশ কোথা থেকে এল?


তবে কেউ জানত না,
সেই লাশ রাজুর ছিল না।
লাশটা ছিল এক ভবঘুরের, যার গায়ে রাজুর হুবহু জামা, গলায় ছিল রাজুর ঘড়ি।
ওই ঘড়ি রাজুকে ভয় দেখানোর সময় খোলে ফেলা হয়েছিল।
রাজুকে গুম করেছিল কিছু বখাটে—রানার কথায়।
কিন্তু রাজু আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়, আর স্থানীয় এক বৃদ্ধ কবি তাকে খুঁজে পেয়ে আশ্রয় দেয়।
রাজু তখন ভুলে যায় নিজের নাম, ভুলে যায় চিঠি, তুলি, শহর।

রাজু আসলেই মরে নাই, সেদিন অন্য একটি ছেলে মারা গেছিল, চেহেরাটা এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছিল,যে বুজা যাচ্ছিল না, কারন তার হাতে রাজুর ঘড়ি পাওয়া গেছিল, সেখান থেকে সবাই রাজু হিসাবে ধরে নিসে।

কিন্তু! অন্য দিকে রাজু.

রাত তখন গভীর।
আকাশে চাঁদের আলো জমে আছে একাকিত্বের চাদরে।
শহরের প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ বসতির মধ্যে, ছোট একটি টিনের ঘর, যার বারান্দায় বসে এক বৃদ্ধ কবি ধূপ জ্বালিয়ে নিজের হাতে লেখা পুরোনো কবিতা গুছিয়ে নিচ্ছেন।

তার পাশেই বসে আছে রাজু।
চোখে অপার শূন্যতা, মস্তিষ্ক যেনো একটা অদৃশ্য কুয়াশায় ঢাকা।
কবি তার দিকে তাকিয়ে বলেন—

“তুমি হয়তো ভুলে গেছো, তুমি কে।
কিন্তু শব্দ তো কখনো ভুলে না কার কণ্ঠে জন্ম নেয়।”

রাজু নিরুত্তর।
তার মাঝে কোনো স্মৃতির রেখাপাত নেই।
তবে প্রতিরাতে কবি যখন কবিতা পড়ে, রাজুর বুকের ভেতরে যেনো কাঁপন উঠে।
কোনো শব্দ, কোনো পঙক্তি, কোনো নিরবতা তাকে অস্থির করে তোলে।
সে কবির পাশে বসে, চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার লেখা কাগজগুলোর দিকে।
কখনো কখনো গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় তার ঠোঁটের কোণে এক অচেনা নাম ফিসফিস করে—
“তুলি…”


বৃদ্ধ কবির একমাত্র মেয়ে—জান্নাতুল পুষ্প।
নাম যেমন কোমল, হৃদয় তেমনি গভীর।
রাজুকে প্রথম যখন দেখেছিল, একটা অপরিচিত মানবতার আলো তার চোখে ধরা দিয়েছিল।
প্রথমে তাকে সহানুভূতির চোখে দেখলেও, ধীরে ধীরে তার প্রতি যে টান জন্ম নেয়, সেটা আর সহজ ছিল না।

রাজুর নিরবতা পুষ্পের হৃদয়ে শব্দের মতন প্রতিধ্বনি তুলতো।
সে অপেক্ষা করতো কখন রাজু একবার তাকাবে, কখন কিছু বলবে।
কিন্তু রাজু তখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলে বসে আছে, স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এক ছায়ার মতো।

তবুও পুষ্প হাল ছাড়ে না।
সে প্রতিদিন রাজুর পাশে বসে, কবিতা পড়ে শোনায়, পুরোনো বই দেখায়, আর রাজুর চোখে কিছু খুঁজে ফেরে।
একদিন কবি হঠাৎ মেয়েকে বলে বসেন—

“পুষ্প, রাজুর মধ্যে এমন কিছু আছে যা কবিতার মতো গভীর।
সে যদি ফিরে পায় তার শব্দ, তার কণ্ঠ, তবে তুমি তাকে আর পাবে না… জানো তো?”

পুষ্প কোনো উত্তর দেয় না।
শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীরে চেপে রাখে।


একদিন রাজু হঠাৎ উঠে গিয়ে কবির লেখার ঘরে ঢুকে পড়ে।
পুরনো কাগজে কলম নিয়ে বসে যায়।
অনেকক্ষণ ধরে সে চুপচাপ বসে থাকে, তারপর লিখে ফেলে এক পঙক্তি—

“ভালোবাসা কখনো মরে না,
শুধু হারিয়ে যায় এক চিঠির ভাঁজে…”

কবি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন।
পুষ্প এগিয়ে এসে দেখে রাজুর হাত কাঁপছে, কিন্তু চোখে জল।

“তুমি লিখছো?”
পুষ্প প্রশ্ন করে।

রাজু ধীরে মাথা নাড়ে।
তার ঠোঁট কাঁপে, এক শব্দ উচ্চারিত হয়—

“তুলি…”

পুষ্প বুঝে যায়, রাজুর স্মৃতি ফিরতে শুরু করেছে।


তারপরের দিনগুলো যেনো এক আশ্চর্য পুনর্জন্মের মতো।
রাজু প্রতিদিন লিখে চলে।
কখনো ছেঁড়া কাগজে, কখনো খাতায়।
তার প্রতিটি পঙক্তি যেনো তুলির কাছে লেখা একেকটি চিঠি।

সেই চিঠি গুলো নিয়ে কবি সিদ্ধান্ত নেন—
এই লেখা গুলো বই আকারে ছাপানো হবে।
রাজু তখন নিজের নামের জায়গায় লিখে —রাজু আহমেদ।
তখন থেকে কবি থাকে রাজু বলে ডাকতো।

বইয়ের নাম হয়—”চিঠির শেষ শব্দ”
প্রচ্ছদে একটি ধূসর রঙের খাম, তার উপর একটি নামহীন চিঠির ছবি।
বইটি প্রথম প্রকাশ পায় বইমেলায়।
প্রথম দিনেই কয়েকশো কপি বিক্রি হয়।

পাঠকরা বিস্ময়ে বলছে—
“এই লেখক কে? এমন হৃদয়বিদারক ভাষা… যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার প্রতিধ্বনি।”
এক নাম, এক বই, রাতারাতি হয়ে ওঠে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।


সেই বইমেলায় একদিন তুলি আসে স্কুল ছুটি শেষে।
একটা স্টলে গিয়ে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় এক বইয়ে—
“চিঠির শেষ শব্দ”
লেখক: রাজু আহমেদ

হাতটা কাঁপে।
চোখ ভিজে ওঠে।

সে বইটি তুলে নেয়, পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখ পড়ে এক লাইন dedic ation-এর ওপর—

“তুলির জন্য,
যার ভালোবাসা আমায় লিখতে শিখিয়েছে…
মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছে।”

তুলির পৃথিবী থেমে যায় সেদিন সেই মুহূর্তে।

বইমেলার ভিড় একটু একটু করে পাতলা হয়ে আসছিল।
তুলি হাতের কাঁপুনি থামাতে পারছিল না।
বইয়ের সেই পাতায় চোখ আটকে আছে তার—

“তুলির জন্য,
যার ভালোবাসা আমায় লিখতে শিখিয়েছে…
মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছে।”

সে বইটা শক্ত করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে।
প্রতিটি শব্দ যেন রাজুর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে, তার মনে হয় রাজু এখনো বেঁচে আছে।
তবে এক প্রশ্ন জ্বলে উঠে হৃদয়ের গভীরে—
“রাজু যদি বেঁচে থাকে, তবে সে আমার কাছে আসছে না কেন?”


তুলি এরপর প্রতিটি সম্ভাব্য পথ ধরতে থাকে।
সে খোঁজ নেয় বইমেলার প্রকাশকদের কাছ থেকে, যে স্টলে সে বই কিনেছিল সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—
“এই লেখক কোথায় থাকেন? আপনি কি জানেন?

”বইটি এসেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় প্রকাশনী থেকে। এরপর একে একে তুলি পৌঁছে যায় প্রকাশনা অফিস, সম্পাদক, বইয়ের পরিবেশক, এবং লেখকের দেওয়া ফোন নম্বর—সবই বন্ধ। কেউ জানে না লেখকের আসল পরিচয়।

এদিকে বইমেলার প্রধান আয়োজক আয়েশ ইকবাল রাজিব, যে নিজেও একজন লেখক ও পরিচালক, তার সঙ্গে তুলি যোগাযোগ করে। আয়েশও অবাক—তুলির চোখে এক ধরণের অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখে সে বোঝে, এ কোনো সাধারণ কিছু না, তুলি পুরো বিষয় টা বলে, আয়েশ অবাক হয়ে যায়।

কিন্তু কেউই সরাসরি কিছু বলতে পারে না।
তাদের কথায় শুধু একটা নাম উঠে আসে—“এক কবি তার প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন।”

তুলি তখন ভাবে—এই গল্প, এই প্রতিভা, এই আবেগ—একজন সাধারণ লেখকের নয়।
সে বইমেলার আয়োজকদের সঙ্গে দেখা করে।

তুলি বলে— “আমরা কেন সেরা লেখকদের খুঁজে বের করি না?
আমরা কেন এমন একটা ইভেন্ট করি না যেখানে ৬৪ জেলার মধ্যে যারা সত্যিকারের প্রতিভাবান, তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে?
তাহলে আমরা তাকে খুঁজে পেতে পারি।”

আয়োজকরা প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু তুলির আবেগ ও যুক্তির কাছে হার মানে।
তারা রাজি হয়।

তুলি নিজের উদ্যোগে অনেক জেলায় খবর পাঠায়, নতুন প্রতিভাবান লেখকদের আহ্বান জানায়।
পুরস্কারের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়।
রাজু’র লেখা বই এর নামও আলোচনায় উঠে আসে—“চিঠির শেষ শব্দ”।


অন্যদিকে: রাজু ও পুষ্প

রাজু এখন কবির কন্যা জান্নাতুল পুষ্পর সাথে অনেক বেশি সময় কাটায়।
পুষ্প তাকে নিয়ে ছোট ছোট শহরে ঘুরতে যায়—নদীর ঘাটে, পুরোনো মন্দিরে, অরণ্যের গভীরে।
তারা বসে, রাজু কবিতা পড়ে শোনায়, পুষ্প গিটারে সুর তোলে।

একদিন তারা চায়ের দোকানে বসে— পুষ্প বলে,
“তুমি জানো, আমি কখনো চাইনি তুমি আগের সবকিছু মনে রাখো।
কারণ আমি জানতাম, সেই স্মৃতি ফিরলে আমি তোমাকে হারাবো।
তবু চাই তুমি পুরো মানুষ হয়ে উঠো।”

রাজু চুপ করে থাকে।
সে জানে, তার ভিতরে কিছু একটার স্পষ্ট হয়ে ওঠা শুরু হয়েছে।
তার স্বপ্নে এখন তুলি আসে, চিঠি আসে, কোনো পুরোনো রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ে…


একদিন রাজু একটি অনুষ্ঠানের খবর দেখে— “সেরা লেখক সম্মাননা, ঢাকা”

সেখানে তার বইয়ের নাম দেখে তার বুক কেঁপে উঠে।

কবি তাকে উৎসাহ দেন—
“তুমি যাও, তোমার শব্দের কাছে ফিরে যাও।
যদি কেউ তোমার কথা স্মরণ করে, সে ওইখানেই থাকবে।”

সন্ধ্যা তখন কেবল নামতে শুরু করেছে।

ঢাকার অমর একুশে বইমেলার আলো আর শব্দের মাঝে আজ একটা ভিন্ন আবহ।
অনুষ্ঠান মঞ্চে শ্রেষ্ঠ লেখকদের পুরস্কার বিতরণ চলছে।
সঞ্চালনায় তুলি—কণ্ঠে এক ধরনের চাপা কাঁপুনি, চোখে দীর্ঘদিনের অপেক্ষার প্রহর।

তার হাতের কাগজে লেখা—

“রাজু আহমেদ – আবেগধর্মী সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ লেখক”
কে এই লেখক দেখার জন্য তুলি পাগল হয়ে আছে, মাইক দিয়ে বলতে লাগল, সেরা লেখক, চিঠির শেষ শব্দের, রাজু আহমেদ।

চোখ নামিয়ে তাকায় সে,
পুরস্কার নেওয়ার জন্য মঞ্চে আসছেন একজন।
সাদা পাঞ্জাবি, শান্ত মুখ, গলায় অচেনা আত্মবিশ্বাস।

তুলি তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে।
এ তো রাজু, তাহলে রাজু মারা যায় নাই, তাহলে ওই লাশটা কার, আমার কাছে কেন গেলো না, মনে মনে ভাবতে থাকে।
দেখে… দেখে… বুক ধকধক করে উঠছে।
এ যে… রাজু!

সে মুখ নিচু করে পুরস্কার নেয়।

তুলির হাত কেঁপে উঠে। চোখ ভিজে যায়।

তবে রাজুর চোখে কোনো চেনার ছাপ নেই।
এক মুহূর্তে তুলি ফিসফিস করে—

“রাজু… তুমি চিনতে পারো না আমায়?”

রাজু মাথা নাড়ে।
তার চোখে স্পষ্ট বিভ্রান্তি।

“আমি… আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি?”

তুলির ভিতরটা ভেঙে পড়ে,
কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
শুধু সেই পুরস্কারের মঞ্চ থেকে সরে গিয়ে একা একা বসে পড়ে পেছনের একটি বেঞ্চে।

তুলি আর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না।
সে জানতে চায়, “রাজু কোথায় থাকে?”
“কে তাকে এখানে এনেছে?”
“কে তার বই প্রকাশ করেছে?”

বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে খোঁজ নেয়, অবশেষে একজন বলেন—

রাজু তার আগের কোন কিছু মনে নাই ,
এখন..

“একজন কবির সঙ্গে থাকেন, পুরান ঢাকার এক গলিতে টিনের ছোট বাসা। তার লেখা ওই কবিই ছাপিয়েছেন।”

তুলি এক মুহূর্ত দেরি না করে রিকশা নেয়।


কবির বাসায় তুলির আগমন

পুরান ঢাকার গলি পেরিয়ে সে আসে এক পুরনো দোতলা টিনশেড বাড়ির সামনে।

ভেতরে প্রবেশ করে দেখেই চোখে পড়ে দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি ক্যালেন্ডার—
উপর লেখা, “শব্দের নীড় – কবি হারুন উর রশিদ”।

দরজায় কড়া নাড়ে।

বৃদ্ধ কবি দরজা খুলে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।

তুলির চোখে জল, কণ্ঠে কাঁপুনি—

“আমি রাজুর খোঁজে এসেছি… ও… ওর সব ভুলে গেছে। আপনি জানেন?”

কবি ধীরে বলেন—

“রাজু এখন শান্ত। তুমি আসলে সেই শান্তি ভেঙে যাবে… তুমি ওর কি হও?”

তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলে—

“আমি ওর অপেক্ষার নাম। আমি ওর সমস্ত চিঠির প্রাপক। আমি… ওর ভালোবাসা।”

কবি মুখ ফিরিয়ে নেন।

“তোমার চলে আসা ওর স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে, আমরা থাকে হারিয়ে যেতে দিতে পাড়ি না ।
আমার মেয়ে… ও… ও রাজুকে ভালোবাসে। আমি চাই না সে হারাক…”


পুষ্পর আবেগভরা প্রকাশ

তুলির কান্না বাড়তে থাকে।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে পুষ্প সব শুনে ফেলে।

সে এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে হাত রাখে তুলির কাঁধে।

“আপনি তুলি?”

তুলি চমকে তাকায়।

পুষ্পর চোখে জল, মুখে এক বিস্ময়কর শান্তি।

“রাজু আপনাকে চেনে না, ঠিক।
কিন্তু যখন সে রাতে কবিতা লেখে, ঘুমের ঘোরে একটা নাম ফিসফিস করে—
‘তুলি… তুমি আসবে তো…’”

তুলি ভেঙে পড়ে মেঝেতে।

পুষ্প বসে তার পাশে।

“আমি তাকে ভালোবেসেছি।
প্রতিদিন, প্রতিটি কবিতায়।
কিন্তু আমি বুঝি… আপনি ছাড়া সে পূর্ণ নয়।
তাকে আপনি ফিরিয়ে আনুন।
আমার ভালোবাসা ওকে আটকে রাখতে নয়—ওকে খুঁজে দিতে।”


কবি আগে থেকে জানতেন, রাজু আর তুলির বিষয় আয়েশের কাছ থেকে সব শুনছে,

পুষ্পর কথায় কবি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

তার ঠোঁটে এক দীর্ঘশ্বাস, চোখে কিছুটা জল।

“আমি কবি, কিন্তু আজ আমার মেয়েই আমার লেখা শেষ পঙক্তি লিখে দিলো…”

তিনি ধীরে বলেন—

“তুমি রাজুকে দেখে যাও।
তোমার উপস্থিতি যদি ওর স্মৃতি ফেরায়, তবে ও নিজের কাছেই ফিরবে।
ভালোবাসা ফিরিয়ে আনে—আর আমি চাই, আমার কবিতার চরিত্র তার সত্যিকারের গল্পে ফিরে যাক।”

তুলি কবির ইশারায় রাজুর ঘরে প্রবেশ করে।

রাজু জানালার ধারে বসে বই পড়ছে।

তাকে দেখে থমকে যায়।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তুলির চোখে।

তুলি এগিয়ে আসে, একখানা চিঠি বাড়িয়ে দেয়।

“তুমি লিখেছিলে… ‘ভালোবাসা কখনো মরে না, শুধু হারিয়ে যায় এক চিঠির ভাঁজে।’
আজ আমি সেই চিঠির ভাঁজ খুলে দিয়েছি, রাজু।”

রাজু’র চোখ কাঁপে।

হাত দিয়ে কপালে চাপ দেয়।

ধীরে ধীরে চোখ ভিজে আসে।

চোখ বন্ধ করে বলে—

“তুলি… আমি… আমি কি হারিয়ে গেছিলাম?”

তুলি ফিসফিস করে বলে—

“আমি তো কোনোদিন থেমে থাকিনি…”

আর পড়ুন

পর্ব :১, চিঠির শেষ শব্দ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top