লেখক: আয়েশ ইকবাল রাজিব।
“কিছু সম্পর্ক শেষ হয় না… শুধু একটি চিঠির শেষ লাইনে আটকে থাকে।”
রাজু—একজন স্বপ্নবাজ ছেলেমানুষ। ঢাকার একটি ছোট উপশহরে তার বেড়ে ওঠা। মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে। বাবা হকার, মা গৃহিণী। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেড়ে উঠেছে সে। ভরসা ছিল শুধু লেখালেখি আর আঁকাআঁকির প্রতি ভালোবাসা।
তুলি—ঢাকারই নামকরা কলেজে পড়ুয়া এক সাহসী মেয়ে। বাবা কলেজ অধ্যাপক, মা স্কুল শিক্ষিকা। তুলির চোখে ছিল মুক্ত আকাশ দেখার স্বপ্ন, মনে ছিল প্রেমে পড়ার সাহস।
তাদের দেখা হয়েছিল এক সাহিত্য প্রতিযোগিতায়। রাজু যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটা কবিতা পড়ছিল—
“এই শহরে মানুষ ভিড় করে,
কিন্তু কেউ কারো অপেক্ষায় থাকে না…
আমি তোমার অপেক্ষায় আছি—তুমি আসবে কি?”
তুলি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার ভিতরের কিছু যেন কেঁপে উঠেছিল। এরপর বন্ধুত্ব, তারপর একটা চিঠি…
তুলি রাজুকে প্রথম চিঠি লেখে—কোনো মেসেজ না, ফোন কল না, সরাসরি কাগজে লেখা চিঠি। সেখানে লেখা ছিল—
“প্রিয় অচেনা কবি,
তোমার কণ্ঠে যখন সেই কবিতাটা শুনলাম, মনে হলো এই শহরের প্রতিটা ব্যস্ত লোকের মাঝে কেউ একজন আমার মতোই অপেক্ষায় থাকে।
আমি জানি না তুমি কে, কিন্তু আমি চিঠি লিখলাম… যদি তোমার কাছে কবিতার মতো কিছু অনুভব রেখে যেতে পারি।
– তুলি”
সাকল বেলা রাজু ঘুম থেকে উঠে দেখে, তার জানালার পাশে কে যেন একটা কি রেখে গেছে, রাজু প্রথমে চমকে গিয়েছিল। সে তো এমন কিছু আশা করেনি। কি হতে পাড়ে এটা, জানালার পাশ গিয়ে দেখে উপরে রাজুর নাম লেখা একটা চিঠি, কে এই চিঠি দিতে পাড়ে, রাজু চিঠিটা খুলে দেখে সেখানে লেখা। রাজু তোমার ওই সাহিত্য মায়া ঝড়ানো ভালোবাসটুক আমাকে দিবে।
রাজু তো অবাক হয়ে যায়, কে হতে পাড়ে, কিন্তু খোজ পায় না, তবে প্রতিদিন সকাল বেলা একটা করে চিঠি থাকে, যেখানে রাজু কে নিয়ে কথা লিখা থাকে, এভাবে প্রায় ১মাস চলে চিঠি দেওয়া।
একদিন রাজু তার বন্ধুকে সব বিষয় খুলে বলে, তার বন্ধু বলে রাজু মেয়ে টা তোর প্রেমে পড়ছে, রাজু কোন মেয়ে জানি না, তবে মেয়েটার ভিতর একটা মায়া আছে আর যাইহোক সে একটা ভালো মেয়ে হবে আমার মতে।
তবে মামা শুন, একটু খোজ নিয়ে দেখ মেয়ে টা কে হতে পাড়ে। তবে আমাকে যে চিঠি দেয়৷ এই বিষয় যেন কেউ না জানে।
ওকে মামা,জানবে না। দেখি কে হতে পাড়ে।
১ সাপ্তাহ পড়।
—রাজুর বন্ধু বলে মামা তোরে যে চিঠি দেয় সে তো তুলি, আমি ওরে দেখছি, জানালার পাশে আসতে সেদিন থেকে আমি ফলো করতাম তোর জানালার পাশে, তারপর গিয়ে দেখি তুলি।
রাজু তুলি টা কে।
ওর বাবার অনেক টাকা পয়সা মামা, বেশি দূর না যাওয়া ভালো।
রাজু, কিযে বলোস মামা।
তুলিকে রাজু মনে মনে খুজতে থাকে, তুলি ও আর চিঠি দেয় না। হঠাৎ একদিন তুলি এসে রাজুকে বলে, আপনি রাজু ভাইয়া না, রাজু বললে হ্যা, আপনি কে, আমি তুলি। বলে চলে গেলো। রাজু তুলিকে দেখে বিশ্বাস করতে পাড়ে না৷ এত সুন্দর মেয়ে রাজুকে চিঠি দিবে। রাজু এসে তার বন্ধু কে বলে।
মামা, তুলির সাথে দেখা হলো।
কিভাবে, বেটা তুলি নিযে হঠাৎ করে এসে আমাকে বলল,আপনি রাজু ভাইয়া না, আমি বললাম হ্যা, সে বলল,আমি তুলি,
মামা বেশি দূর না যাওয়া ভালো।
রাজুর সাথে আবার তুলির দেখা
রাজু বললো চিঠি দেওয়া বন্ধ হলো কেন।
চিঠি কি করে দিবো, যদি কোন রিপ্লাই না আসে।
তারপর আবার শুরু।
চিঠির বদল চলতে থাকে। তারা একে অপরকে চিঠিতে মনের কথা বলে—
“তুমি কি জানো, আমি রাত জেগে তোমার চিঠি পড়ি।
প্রতিটা শব্দে তুমি যে দৃষ্টিতে তাকাও, আমি সেটা দেখি।
– রাজু”
“তোমার আঁকা একটা ছবি, আমার বুকের ডায়েরির মাঝে রেখেছি।
যেন তুমি সবসময় আমার হৃদয়ে থাকো।
– তুলি”
ধীরে ধীরে তারা একসাথে বেড়াতে যায়—সোনারগাঁয়ের প্রাচীন ইটের গলি, বইমেলার চত্বরে হাত ধরে হাঁটা, সন্ধ্যার রঙে ভেজা ছাদে তারা দেখা করে। রাজু কবিতা পড়ে, তুলি শোনে। তুলি ছবি আঁকে, রাজু তার জন্য শব্দ খোঁজে।
তাদের সম্পর্ক গভীর হতে হতে একদিন তারা সিদ্ধান্ত নেয়—বিয়ে করবে।
তুলি বাড়িতে জানায়। তার বাবা-মা কঠিনভাবে মানা করে। “এক হকারের ছেলের সাথে? অসম্ভব!” তুলির বড় ভাই রানা আরও রেগে যায়।
রানার মুখের কথা ছিল—
“ওকে আর যদি আমার বোনের কাছাকাছি দেখি, কবর দিই জীবিত।”
রাজু তখন বলেছিল তুলিকে—“চলো পালিয়ে যাই।”
কিন্তু তুলি বলেছিল—“না রাজু, ভালোবাসা পালিয়ে যায় না, বুক পেতে লড়াই করে। আমি লড়ব।”
“রাজু,
আমি হয়ত তোমার জীবনকে সহজ করে দিতে পারব না, কিন্তু তুমি আমায় নিয়েই তোমার জীবন সাজাবে।
আমি বাঁচব না তোমাকে ছাড়া। আমরা এক হব—এটাই ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত।
– চিরকালের তুলি”
এক সন্ধ্যায় রাজু বাইরে গিয়েছিল তুলির জন্য উপহার আনতে। সে চিঠি লিখে রেখেছিল তুলির জন্য:
“তুলি,
আজ একটা নীল শাড়ি দেখেছি, ভাবলাম তোমার চোখের রঙের মতো।
একটা ছোট আংটি কিনলাম, যা দিয়ে তোমায় বলব—‘তুমি আমার চাঁদ’।
দেখা হবে সন্ধ্যায়।
– রাজু”
কিন্তু সে সন্ধ্যা আর এল না…
পরদিন সকালে স্টেশনের পাশে পাওয়া যায় রাজুর নিথর দেহ। কারও গায়ে দোষ পড়ল না। পুলিশ বলল—আত্মহত্যা।
তুলি স্তব্ধ। রাজু? আত্মহত্যা?
অসম্ভব।
তুলি রাজুর সব চিঠি পড়ে, তার ডায়েরি ঘেঁটে খুঁজে পায় কিছু নাম্বার, কিছু ঠিকানা। সেগুলো ধরে খুঁজে খুঁজে সে বের করে রাজুর শেষ ফোন রেকর্ডিং।
“তুই যদি আমার বোনের পেছনে আর ঘোরাঘুরি করিস, মনে রাখ, তোর লাশও খুঁজে পাবে না।”
ভয়েসটি রানার।
তুলি কান্না থামিয়ে দাঁড়ায়।
“তুই আমার ভাই হতে পারিস, কিন্তু আমার প্রেমিকের খুনি তো বটেই।”
সে গোপনে রানার অপরাধের তথ্য জোগাড় করে, মিডিয়া, আইন, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দেয়।
জনগণ জেগে ওঠে। দেশ কাঁদে রাজুর জন্য। রানা গ্রেপ্তার হয়। আদালতে মামলা হয়।
ক’মাস পর তুলি রাজুর ডায়েরিতে পায় শেষ চিঠি, যেটা হয়তো রাজু পাঠানোর আগেই মরে গিয়েছিল।
“আমার তুলি,
যদি কোনোদিন আমি না থাকি, তুমি কাঁদবে না।
আমার প্রতিটা চিঠি তোমার বুকে রাখো।
আমার ছায়া হবে তোমার পাশে,
আমার শব্দ থাকবে তোমার মুখে,
আমার চিঠির শেষ লাইনে থাকবে—‘তোমায় ভালোবাসি, আজীবন।’
– চিরপ্রেমিক, রাজু”
তুলি এখন লেখক। তার বইয়ের নাম—“চিঠির শেষ শব্দ”।
বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লেখা—
“যাকে হারিয়েও পাই, সেই রাজুকে।”
প্রতিদিন সে ছাদে গিয়ে রাজুর লেখা চিঠিগুলো পড়ে। মাঝে মাঝে বাতাসে চিঠিগুলো ভেসে ওঠে, আর আকাশে যেন কেউ কবিতা বলে ওঠে—
“তুমি যদি চলে যাও, আমি চিঠি হয়ে যাব।
প্রতিদিন পড়বে আমাকে,
আর আমি রয়ে যাব—তোমার চোখে।”