পর্ব : ২
লেখক : আয়েশ ইকবাল রাজিব
রাতের শহর তখন নিস্তব্ধ। ফুটপাতের বাতিগুলো আধো আঁধারে কাঁপছে। দিনভর ধুলো, শব্দ, হর্ন, মানুষের ভিড়ে ভরা এই শহর যেন রাত নামলেই খোলসে ঢুকে যায়। চারদিকে একধরনের অচেনা নীরবতা নেমে আসে, শুধু মাঝেমধ্যে দূর থেকে কুকুরের ডাক কিংবা কোনো বাসের ক্লান্ত শব্দ এসে ভাঙে সেই নিস্তব্ধতা।
পতিক শুয়ে আছে এক পুরনো দোকানের ভাঙা বারান্দায়। শরীর কুণ্ডলী পাকানো, মুখ শুকনো, ঠোঁট ফেটে রক্ত শুকিয়ে গেছে। চোখদুটো যেন গহ্বরের মতো গভীর, তলানিতে শুধু অন্ধকার। টানা তিনদিন কোনো ঠিকমতো খাবার জোটেনি। ক্ষুধা শরীরকে জ্বালিয়ে তুলছে, কিন্তু কাঁদার শক্তিও নেই তার। কান্না অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে।
এই শহর তার কিছু দেয়নি। শুধু কেড়ে নিয়েছে—ভরসা, সম্পর্ক, মমতা। এতিমখানার ঘৃণা, রাস্তায় মানুষের তাচ্ছিল্য, ক্ষুধার দীর্ঘশ্বাস—এসব নিয়েই সে বড় হয়েছে। আজ যেন শরীরের সঙ্গে তার আত্মাও মরে যেতে বসেছে।
ঠিক এমন সময়, অন্ধকার গলিপথ থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে আসছিল। হাতে কাপড়ের ব্যাগ, গায়ে মলিন শার্ট, চোখে ক্লান্তি থাকলেও মুখে অদ্ভুত এক মমতার ছায়া। তিনি শহরের পরিচিত এক মানুষ—ফারুক সাঈদ, কলেজশিক্ষক।
শহরের অনেকেই তাকে চিনত। ছাত্রদের বিনা খরচে পড়ানো, হাসপাতালে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, রাস্তার অসহায়দের খুঁজে সাহায্য করা—এসব ছিল তার অভ্যাস।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ফুটপাতে শুয়ে থাকা পতিকের দিকে। হাড়গোড় বেরিয়ে আসা শরীর, ঠোঁট সাদা, শ্বাস যেন আসছে-যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে বললেন—
—“ওরে বাবা, বেঁচে আছিস?”
পতিক ধীরে চোখ মেললো। চোখের ভেতর শূন্যতা, ঠোঁট শুধু কাঁপছে। কিছুক্ষণ পর ফিসফিস করে বলল—
—“পানি… একটু পানি…”
ফারুক সাঈদ দেরি করলেন না। নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার ঠোঁটে ধরলেন। পতিক তৃষ্ণার্তের মতো এক নিঃশ্বাসে অর্ধেক বোতল খেয়ে নিলো। তারপর নিথর হয়ে পড়লো আবার।
—“বাবা, তুই এখানে একা কেন?”
পতিক এক দৃষ্টিতে তাকাল। গলার স্বর যেন ভাঙা বাঁশির মতো করুণ।
—“আমি এতিম। আমার কেউ নাই।”
এই শব্দগুলো শুনে ফারুক সাঈদের বুকটা কেঁপে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ নিরব দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর আস্তে বললেন—
—“চল, আমার সঙ্গে চল। তোর ঠিকানা আমি হবো।”
পতিক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। জীবনে প্রথমবার কেউ তাকে বললো—“তোর ঠিকানা আমি হবো।”
ফারুক সাঈদ হাত ধরে তাকে উঠালেন। দুর্বল শরীর, টলতে টলতে হাঁটছে, তবুও মনে হচ্ছিল যেন পায়ের নিচে নতুন করে মাটি পেলো।
—
ফারুক সাঈদের বাসা শহরের পুরনো অংশে, একতলা টিনের ঘর, সামনে ছোট্ট উঠান। ঘরে ঢুকতেই পতিক থমকে দাঁড়ালো। তার কাছে মনে হলো, এ যেন স্বপ্ন। টেবিলে বই সাজানো, দেয়ালে আলোর ছটা, কোণায় নামাজের জায়গা।
—“বাবা, প্রথমে গোসল কর। তারপর খাওয়া দিবো।”
পতিক কেঁপে উঠলো। কতদিন কেউ এভাবে ‘বাবা’ বলে ডাকেনি! মাথা নিচু করে গোসলখানায় ঢুকে গেল। ময়লা ধুলো ধুয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, তার ভেতরকার অন্ধকারও যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে।
গোসল শেষে খাওয়ার জন্য সামনে রাখা হলো গরম ভাত, ডাল, ডিম ভাজি আর এক গ্লাস পানি। কাঁপা হাতে ভাত মুখে তুললো। অঝোরে পানি ঝরতে লাগলো চোখ থেকে। মনে হচ্ছিল, মা যদি থাকতেন, হয়তো এমনভাবেই খাইয়ে দিতেন।
ফারুক সাঈদ শান্ত গলায় বললেন—
—“কান্না করিস না, খা। এখন থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। তবে একটা শর্ত আছে—পড়াশোনা করবি, মানুষ হবি।”
পতিকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সে এতদিন ভেবেছিল, সে শুধু একটা বোঝা। অথচ কেউ বলছে—সে মানুষ হতে পারবে!
পরদিন ভোরে ফারুক সাঈদ তাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। নামাজ শেষে বললেন—
—“শুন, জ্ঞানের আলো ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তুই স্কুলে ভর্তি হবি।”
পতিক ভয় পেল। এতিমখানায় নাম-ধাম লেখা ছাড়া কিছু শেখেনি। স্কুলে কীভাবে পড়বে? কিন্তু ফারুক সাঈদ বললেন—
—“ভয় পাস না। তুই পারবি।”
ভর্তি হওয়ার দিন শিক্ষকরা অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন। “এতিমখানার ছেলে, টিকবে তো?”—প্রশ্ন ভাসছিল তাদের চোখে। কিন্তু ফারুক সাঈদ দৃঢ় গলায় বললেন—
—“এ ছেলে একদিন সবার উত্তর দেবে।”
প্রথমদিনেই পতিক বুঝল, তার জীবন বদলাচ্ছে। নতুন খাতা, নতুন বই, নতুন অক্ষর। ভয় থাকলেও ভেতরে জন্ম নিলো অদ্ভুত আগ্রহ।
রাতে সে খাতার পাতায় অক্ষর আঁকতো। ফারুক সাঈদ পাশে বসে বলতেন—
—“অক্ষর মানে শুধু লেখা না। প্রতিটা অক্ষর মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়।”
দিন যেতে যেতে পতিক পড়াশোনায় এগিয়ে যেতে লাগলো। শিক্ষকরা অবাক হয়ে দেখলেন, এতিমখানার সেই চুপচাপ ছেলে এখন সবার সেরা ছাত্র।
একদিন ক্লাসে বসে আঁকাআঁকি করছিল পতিক। পাশের বেঞ্চে বসা মেয়ে এগিয়ে এসে বললো—
—“তুমি আঁকতে জানো?”
পতিক মাথা নাড়লো। মেয়ে হাসলো—
—“তোমার নাম কী?”
—“পতিক।”
মেয়েটির নাম ছিল আরিবা। চোখে কোমলতা, কথায় মিষ্টি স্বর। সে কখনো পতিককে “এতিম” বলে ডাকেনি। বরং সবসময় পাশে দাঁড়াতো।
ক্লাসে যখন কেউ হাসাহাসি করতো, আরিবা বলতো—
—“মানুষের জন্ম কোথায় হবে, সেটা তার হাতে নাই। কিন্তু মানুষ কেমন হবে, সেটা তার হাতেই।”
পতিক প্রথমবার অনুভব করলো, কেউ তার জন্য দাঁড়াচ্ছে। বুকের ভেতর অচেনা এক ঢেউ উঠলো।
ভালোবাসা—তার কাছে মানে ছিল পাশে দাঁড়ানো, কান্না বোঝা, মানুষ হিসেবে দেখা। আরিবা ঠিক সেটাই করছিল।
—“পতিক, তুমি খুব শক্ত মানুষ,” মাঝে মাঝে বলতো আরিবা।
তখন পতিকের চোখ ভিজে উঠতো। মনে হতো, এই কথাটুকুই তার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
তাদের সম্পর্ক ছিল নির্মল। কোনো হাত ধরা, ফুল দেওয়া নয়—শুধু বোঝাপড়া, ভরসা আর সম্মান।
পতিক ভাবতো—
—“হয়তো এটাই সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় শরীরের না, আত্মার স্পর্শ লাগে।”
বছর গড়িয়ে গেলো। পতিক এখন কলেজে পড়ে। শহরের আলোয় জায়গা করে নিয়েছে, কিন্তু শেকড় ভুলেনি।
রাতে হাঁটতে হাঁটতে ভিক্ষুকদের খাবার দিয়ে আসে। মনে মনে ভাবে—
—“আমিও তো একদিন এমনই ছিলাম। আজ আমি যা হয়েছি, শুধু একজন মানুষের কারণে। তাই আমিও চাই অন্য কাউকে আলো দেখাতে।”
সে এখন লিখতেও শুরু করেছে। ডায়েরির পাতায় জমা হয় তার যন্ত্রণা, ভালোবাসা আর স্বপ্ন।
আরিবার সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। কিন্তু সেটি ভিন্ন—আত্মার ভালোবাসা।
ফারুক সাঈদ গর্বভরে তাকিয়ে থাকেন পতিকের দিকে। তার মনে হয়, একদিন এই ছেলে শুধু নিজের জীবন নয়, অনেকের জীবন আলোকিত করবে।