লেখক: আয়েশ ইকবাল রাজিব
শহরের কোলাহল থেকে দূরে, গাছগাছালির ভেতর দিয়ে ছোট এক শহর থেকে আলিফ বড় স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এলো। ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরোনোর দিনটি ছিল তার জীবনের এক মহোৎসব। বাবা মায়ের চোখে জল, প্রতিবেশীদের অভিনন্দন, আর আলিফের বুকভরা আশা—একদিন সে বড় হবে, দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।
প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গেটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো—এই প্রাঙ্গণ যেন স্বপ্নের উঠোন। সবুজ মাঠ, ছাত্রছাত্রীদের হাসাহাসি, বইয়ের ভারী ব্যাগ—সবই তাকে মুগ্ধ করলো। কিন্তু সেই স্বপ্নের রঙ মলিন হতে সময় লাগলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
সিনিয়রদের র্যাগিংয়ের মুখে পড়লো আলিফ।
“সালাম দিলি না কেন?”
“পা তুলে দাঁড়া, দাঁড়া বলছি!”
লজ্জায় আর ভয়ে আলিফ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। চারপাশে ভিড় জমে উঠলো, কেউ হাসলো, কেউ ছবি তুললো। সেই অপমানের ভার যেন তাকে মাটিতে পুঁতে ফেললো।
ঠিক তখনই, যখন বুক ফেটে কান্না আসছিলো, আলিফের চোখে ধরা দিলো এক অচেনা আলোর ঝলক। সামনের করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো এক মেয়ে। পরনে সাদা ওড়না, মুখে নির্মল হাসি। সেই হাসি যেন আলিফের ভেতরের সব দুঃখ, অপমান আর কষ্টকে এক মুহূর্তে মুছে দিলো।
মেয়েটি একবার তাকিয়ে হেসে চলে গেলো, কিন্তু আলিফ বুঝতে পারলো—তার জীবনের গল্পে নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো সেদিন।
কদিন ধরে আলিফ ছটফট করতে লাগলো মেয়েটির খোঁজে। নাম কী? কোন বিভাগে পড়ে? কে সে?
একদিন তার বন্ধু সজন বললো—
“ওই মেয়ে অবন্তী। প্রাণীবিদ্যা বিভাগে পড়ে। আমাদেরই ব্যাচ।”
শুনেই আলিফের বুক কেঁপে উঠলো। অবন্তী! নামটার ভেতরেই যেন এক অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে।
কিছুদিন পর এক দুপুরে ক্যাম্পাসের মোড়ে অবন্তীকে দেখতে পেলো আলিফ। কিন্তু তার চোখ আটকে গেলো হঠাৎ—অবন্তীর পা কাদায় মাখা, রক্ত ঝরছে।
আলিফ ছুটে গিয়ে বললো,
—“এ কী অবস্থা তোমার? পা রক্তাক্ত কেন?”
অবন্তী অবাক হয়ে তাকালো।
—“আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?”
আলিফ হকচকিয়ে গেলো, তারপর ধীরে বললো,
—“আমরা তো একই ব্যাচের। তুমি প্রাণীবিদ্যায়, আমি ভূগোলে।”
অবন্তী হাসলো। সেই হাসিতে ছিল ব্যথা ঢাকা এক কোমল আলো।
সেদিন থেকে শুরু হলো তাদের কথাবার্তা। বন্ধুত্বের বীজ মাটিতে রোপণ হলো, যা অচিরেই অঙ্কুর গজালো।
দিন কেটে গেলো। ক্লাসের ফাঁকে, লাইব্রেরির করিডরে, অথবা ক্যান্টিনের ভিড়ের মধ্যে আলিফ আর অবন্তী ধীরে ধীরে একে অপরকে খুঁজে নিতে লাগলো।
কথা থেকে হাসি, হাসি থেকে চোখের দৃষ্টি, আর দৃষ্টি থেকে জন্ম নিলো প্রেম।
আলিফ অবন্তীকে বলতো—
“তোমার হাসি যেন আমার সব কষ্ট মুছে দেয়।”
অবন্তী মৃদু স্বরে উত্তর দিতো—
“তুমি আমার ভেতরের একাকীত্ব বুঝতে পারো।”
কিন্তু এই সুখ বেশিদিন টিকলো না।
সিনিয়রদের র্যাগিং দিন দিন বেড়ে গেলো। তারা আলিফকে অবিরাম কষ্ট দিতে লাগলো। অকারণে অপমান, চিৎকার, শাস্তি—সবকিছুতে ক্লান্ত হয়ে গেলো সে।
অবশেষে একদিন সিদ্ধান্ত নিলো, আর ক্যাম্পাসে যাবে না। ফোন বন্ধ করলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেও হারিয়ে গেলো।
অবন্তী খুঁজে ফিরলো তাকে। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলো, ক্লাসে তাকিয়ে থাকলো, কিন্তু আলিফের দেখা নেই।
হঠাৎ একদিন রাস্তায় আলিফকে দেখে সে ছুটে গেলো।
—“তুমি কোথায় ছিলে? হারিয়ে গেলে কেন?”
আলিফের চোখে অশ্রু।
—“ওই বড় ভাইয়েরা আমাকে সহ্য করতে পারে না। অকারণে অত্যাচার করে।”
অবন্তী সব শুনে বাবার কাছে অভিযোগ করলো। তার বাবা ছিলেন নামকরা রাজনৈতিক নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপ দিলেন, এবং অবশেষে সেই সিনিয়রদের শাস্তি হলো।
কিন্তু প্রতিশোধের আগুন এত সহজে নেভে না।
কয়েক মাস পর হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছড়িয়ে পড়লো এক ভয়ংকর খবর। অবন্তীর ছবি নাকি অশ্লীল সাইটে ছড়িয়ে পড়েছে।
চারদিকে হট্টগোল। বন্ধুরা অবন্তীর মুখের দিকে আর তাকালো না, পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিলো।
অবন্তী কেঁদে কেঁদে বললো—
“এগুলো মিথ্যা! আমি নই ওগুলো।”
কেউ বিশ্বাস করলো না।
এমনকি আলিফও নীরবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। প্রেমিক হয়েও তার চোখে কিছুটা সন্দেহ ঝিলিক মারলো।
অবন্তীর বুক ভেঙে গেলো।
একদিন ঘরে দরজা বন্ধ করলো অবন্তী। টেবিলের উপর একটা চিরকুট রেখে গেলো—
“আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছো তোমরা। আমি নির্দোষ, কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার জায়গা নেই। আলিফ, তুমি-ই ছিলে আমার আশ্রয়, অথচ তুমিও আমায় বিশ্বাস করোনি।”
চিরকুটের নিচে কিছু শুকনো অশ্রুবিন্দু।
সেই রাতে অবন্তী নিজেকে শেষ করে দিলো।
খবর শুনে আলিফ ভেঙে পড়লো। বুকের ভেতর অস্থির হাহাকার। পরে জানা গেলো—সবটা ষড়যন্ত্র। সেই বড় ভাই, যে র্যাগিংয়ের নামে তাকে পীড়া দিতো, অবন্তীর বাবার হাতে শাস্তি পাওয়ার প্রতিশোধে এই নোংরা কাজ করেছিলো।
সত্য প্রকাশ পেলো, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবন্তী আর নেই।
আলিফ প্রতিদিন তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। বাতাসে ফিসফিস করে—
“ক্ষমা করো অবন্তী… আমি তোমায় বিশ্বাস করতে পারিনি। তোমার হাসি ছিলো আমার মুক্তি, অথচ তোমার কান্নার পাশে আমি দাঁড়াইনি।”
কবরের নীরবতা তাকে কোনো উত্তর দেয় না। কেবল বাতাসে ভেসে আসে প্রথম দিনের সেই হাসি—যা চিরকাল তার জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তি হয়ে রইলো।